পাহাড় কেটে পথ দেখালেন মাঝি
কেউ অপেক্ষা করছিলেন সরকারের। কেউ আবার ভগবানের প্রতীক্ষায় বুক বাঁধছিলেন। আশা ছিল একটাই, দুইয়ের মধ্যে কেউ এলেই উদ্ধার পাবেন তাঁরা। নিমেষেই সামনের পাহাড়টা কেটে তৈরি হবে রাস্তা। পাহাড় ডিঙোনোর আগেই আর রাস্তায় মরতে হবে না রোগীকে। সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারবেন অসুস্থরা। কিন্তু অপেক্ষাই সার হল হতদরিদ্র গ্রামবাসীদের। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে এল না কেউই।
দশর মাঝির ব্যবহৃত ছেনি, হাতুড়ি ও শাবল
শেষে গ্রামের মানুষকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলেন এক গৃহহীন মজুর। হাতে ছেনি-হাতুড়ি নিয়ে ঘা লাগালেন পাথরে। প্রথমে সটান দাঁড়িয়ে থাকলেও ইচ্ছাশক্তির কাছে ভেঙে পড়ল পাহাড়। এক সময় আস্ত এক পাহাড় কেটে গ্রামের মানুষকে পথ দেখালেন দশরথ মাঝি।
গেহলরগঞ্জ - ওযাজিরগঞ্জের সভ্যতার মাঝে প্রাচীর হয়ে ছিল এই ৩০০ ফুট পাহাড়
দশরথ মাঝি - যিনি পাহাড় পাহাড় কেটে পথ দেখান
১৯৬০ সালের গোড়ার দিকের কথা। উঁচু-নিচু, জাত-পাতের অন্ধকার গ্রাস করেছিল গোটা উত্তর ভারতকে। এই অন্ধকারাচ্ছন্ন অঞ্চল থেকে বাদ পড়েনি বিহারও। কেবল নিচু জাতের মানুষ বলে গয়ার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঠাঁই হয়েছিল গৃহহীন শ্রমিকদের। অন্যান্যদের মতো সমাজের মূলস্রোতে ভিড়তে দেওয়া হয়নি তাঁদের। এমনকী পানীয় জল, বিদ্যুৎ, স্কুল, চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল এই সব মানুষকে। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন মজুররা। কিন্তু সভ্যতা ও তাঁদের মাঝে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল ৩০০ ফুটের এক পাহাড়। প্রতিদিন যা অতিক্রম করে যোগ দিতে হত মজুরদের। দশরথ মাঝির জীবনও এদের থেকে ব্যতিক্রম ছিল না। পাহাড়ের অন্য প্রান্তে ক্ষেতে দিনমজুরের কাজ করতেন তিনি। যা পারিশ্রমিক জুটত তা দিয়েই স্ত্রী ফাগুনী ও পরিবারের ভরনপোষণ হত।
এভাবেই গেহলরগঞ্জে দিব্যি কেটে যাচ্ছিল মাঝির জীবন। কিন্তু হঠাৎই একটা ঘটনা সব বদলে দেয়। কাজকর্ম ছেড়ে আস্ত পাহাড় ভাঙার পণ করে বসেন তিনি। প্রশ্ন জাগে, কী এমন ঘটনা যা মাঝিকে নাড়িয়ে দেয়? গ্রামবাসীরা জানান, পাহাড় অতিক্রম করে ক্ষেতে মজুরের কাজ করতেন মাঝি। কিছুক্ষণ ক্ষেত চষার পরই তাঁর খিদে পেয়ে যেত। বিষয়টা বিলক্ষণ জানতেন তাঁর স্ত্রী ফাগুনী। রাস্তা না থাকায় তাই প্রতিদিন পাহাড় ডিঙিয়ে মাঝির খাবার পৌঁছে দিতেন তিনিই। কিন্তু একদিন এর ব্যতিক্রম ঘটে গেল।
পাহাড়ে পা হড়কে গুরুতর আহত হন ফাগুনী। খাবারের সঙ্গে পড়ে ভাঙল তাঁর জলের পাত্র। শেষে কোনওমতে মাঝির কাছে পৌঁছলেন তিনি। প্রথমে স্ত্রীর ওপর অগ্নিশর্মা হলেও, আহত স্ত্রীকে দেখে চমকে উঠেছিলেন মাঝি। বুঝতে অসুবিধা হল না স্ত্রীর মতো প্রতিদিন গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রায় বাধা দিয়ে চলেছে একটা পাহাড়। আর দেরি না করে সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেললেন মাঝি। একা হাতে পাহাড় ভাঙার প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি। ঠিক যেমন ভাবা, তেমন কাজ।
পাহাড় ভাঙতে গিয়ে প্রথমেই পোষা ছাগলগুলোকে বিক্রি করলেন মাঝি। সেই টাকায় কিনে ফেললেন একটা বড় হাতুড়ি, ছেনি ও শাবল। এরপর পাহাড়ের মাথায় উঠে শুধু ‘ঢং ঢং’ শব্দ। দ্রুত পাহাড় কেটে রাস্তা গড়তে এক সময় ছেড়ে দিলেন দিনমজুরের কাজ। যার ফলে না খেয়ে দিন কাটাতে শুরু করল তাঁর পরিবার। প্রথমে মাঝির এই কাজকে পাগলামো বলেই ঠাওরেছিলেন গ্রামবাসীরা। কিন্তু বছর ঘুরতেই তাঁরা বুঝতে পারলেন পাহাড়ের অনেক পাথরই গুড়িয়ে দিয়েছেন মাঝি। তাই উচ্চতায় কিছুটা কমে গিয়েছে পাথরের স্তূপটা। তবে পাহাড় জয় করলেও পরিবারের খিদে মেটাতে পারলেন না মাঝি। এক সময় না খেতে পেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন ফাগুনী। কাছেপিঠে ডাক্তার বলতে যেতে হত ওয়াজিরগঞ্জ। পাহাড় অতিক্রম করে যার দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। শরীরে বল না থাকায় ডাক্তারের কাছে যাওয়া হল না ফাগুনীর। পাহাড়ের কারণে বিনা চিকিৎসায় মরতে হয় তাঁকে। সবাই ভেবেছিলেন, স্ত্রীর মৃত্যুতে হয়তো ভেঙে পড়বেন মাঝি। আদতে হল ঠিক উল্টোটা। এতদিন যে জেদটা মনের আগুনে লালন করেছিলেন, তাতে যেন ঘি পড়ল। আরও দ্রুত পাথর ভাঙতে লাগলেন তিনি।
তবে আবেগের সঙ্গে এবার কিছুটা বাস্তববোধ কাজে লাগালেন গেহলরগঞ্জের ‘স্বপ্নবিক্রেতা’। গ্রামবাসীদের থেকে টাকা নিয়ে পাহাড়পথে জিনিস পারাপার শুরু করলেন মাঝি। তা দিয়ে কোনওরকমে পরিবারের খিদে মিটল। তবে সবকিছুর মধ্যেও নজর ছিল সেই প্রকান্ড পাথরের চাঁইগুলোর দিকে। ওরাই যেন ছিল মাঝির প্রধান শত্রু। তাই দিনরাত পরিশ্রম করে পাথরগুলো টুকরো টুকরো করাই ছিল মাঝির মূল ব্রত। অনেক সময় পাথরের টুকরোগুলো ছিটকে মাথায় লেগেছে তাঁর। মাথা ফেটে গিয়েছে। তবুও দমেননি মাঝি। মাথার রক্ত মুছে ফের শুরু করেন ‘পাথর হটাও’ অভিযান। এভাবে একার হাতে পাহাড় কাটতে লেগে যায় প্রায় ১০ বছর। সালটা ছিল ১৯৮২। একদিন সন্ধ্যা নামার আগে গ্রামবাসীরা দেখতে পান, ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পাথরে লুটিয়ে পড়েছেন মাঝি। কিন্তু তাঁর পরিশ্রম ব্যর্থ হয়নি। পাহাড়ের গায়ে একফালি সরু গলি তৈরি করতে পেরেছেন তিনি। এরপর পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি আর মাঝির একার স্বপ্ন হয়ে থাকেনি। আশার আলো দেখতে পেয়ে তাতে হাত লাগান গ্রামবাসীরা। দীর্ঘ ২২ বছর পর পাহাড়ের জায়গায় তৈরি হয় ৩০ ফুট চওড়া রাস্তা। মাঝির স্বপ্ন পূর্ণতা পায়।১০ বছর পর পরিশ্রমের পর এখান থেকে সাফল্যের শুরু
এতদিন যে গ্রামবাসীরা পাহাড়ের কারণে চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানে বঞ্চিত হচ্ছিলেন, এবার সেই সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব কমে দাঁড়াল মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। ৩৬০ ফুট লম্বা রাস্তা ব্যবহার করতে পারলেন আশেপাশের ৬০টি গ্রামের মানুষ। তবে রাস্তা গড়েই থেমে থাকেনি মাঝির স্বপ্ন। পরবর্তীকালে এই রাস্তা প্রধান সড়কের সঙ্গে জুড়তে প্রশাসনের কাছে দরবার করেন তিনি। ছোটেন দিল্লিতেও। রাস্তাটাকে আশেপাশের স্টেশনের সঙ্গ জুড়তে স্টেশন মাস্টারদের স্বাক্ষর নেন। দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের সঙ্গে। মাঝির কর্মকাণ্ডের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে যান বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকারের তরফে তাঁর নাম পদ্মশ্রীর জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে বাগড়া দেয় বনমন্ত্রক। বন সৃজন নষ্ট হয়েছে বলে মাঝির কাজকে বেআইনি তকমা দেয় তারা। ততদিনে অবশ্য রাজ্যবাসী তাঁকে প্রিয় খেতাবটা দিয়ে ফেলেছে। দশরথ মাঝি তখন তাঁদের কাছে কেবলই ‘বাবা’।তবে শেষ জীবনটা খুব একটা ভাল কাটেনি মাঝির। কর্কট রোগ থাবা বসায় তাঁর শরীরে। ২০০৭ সালের অগস্টে মারা যান তিনি। যাওয়ার আগে রাজ্য সরকারের দেওয়া জমি হাসপাতালের জন্য দান করে যান। কিন্তু এখনও সেখানে হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি বসলেও আলো আসেনি। এখনও বহু দূরে পানীয় জলের জন্য যেতে হয় গ্রামবাসীদের। তবু ভগবান কিংবা সরকারের দেখা নেই। বাস্তবে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীদের মনে মাঝির শেখানো গান গুনগুন করে বাজে। ‘‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...’’
এতদিন যে গ্রামবাসীরা পাহাড়ের কারণে চিকিৎসা, শিক্ষা, কর্মসংস্থানে বঞ্চিত হচ্ছিলেন, এবার সেই সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব কমে দাঁড়াল মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। ৩৬০ ফুট লম্বা রাস্তা ব্যবহার করতে পারলেন আশেপাশের ৬০টি গ্রামের মানুষ। তবে রাস্তা গড়েই থেমে থাকেনি মাঝির স্বপ্ন। পরবর্তীকালে এই রাস্তা প্রধান সড়কের সঙ্গে জুড়তে প্রশাসনের কাছে দরবার করেন তিনি। ছোটেন দিল্লিতেও। রাস্তাটাকে আশেপাশের স্টেশনের সঙ্গ জুড়তে স্টেশন মাস্টারদের স্বাক্ষর নেন। দেখা করেন মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের সঙ্গে। মাঝির কর্মকাণ্ডের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে যান বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্য সরকারের তরফে তাঁর নাম পদ্মশ্রীর জন্য পাঠানো হয়। কিন্তু তাতে বাগড়া দেয় বনমন্ত্রক। বন সৃজন নষ্ট হয়েছে বলে মাঝির কাজকে বেআইনি তকমা দেয় তারা। ততদিনে অবশ্য রাজ্যবাসী তাঁকে প্রিয় খেতাবটা দিয়ে ফেলেছে। দশরথ মাঝি তখন তাঁদের কাছে কেবলই ‘বাবা’।তবে শেষ জীবনটা খুব একটা ভাল কাটেনি মাঝির। কর্কট রোগ থাবা বসায় তাঁর শরীরে। ২০০৭ সালের অগস্টে মারা যান তিনি। যাওয়ার আগে রাজ্য সরকারের দেওয়া জমি হাসপাতালের জন্য দান করে যান। কিন্তু এখনও সেখানে হাসপাতাল গড়ে ওঠেনি। গ্রামে বিদ্যুতের খুঁটি বসলেও আলো আসেনি। এখনও বহু দূরে পানীয় জলের জন্য যেতে হয় গ্রামবাসীদের। তবু ভগবান কিংবা সরকারের দেখা নেই। বাস্তবে দাঁড়িয়ে গ্রামবাসীদের মনে মাঝির শেখানো গান গুনগুন করে বাজে। ‘‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে...’’